বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৩

মুক্তিযুদ্ধ- " একুশের চেতনা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা "



[ এই লেখাটা লিখতে গিয়ে আমি কিছু বই এবং পত্রিকার সাহায্য নিয়েছি । আবার কিছু কিছু কমেন্ট হুবহু তুলে দিয়েছি । - আমি কৃতজ্ঞ তাঁদের কাছে । ] 

০১. 
একুশের চেতনা” ও “বাংলাদেশের স্বাধীনতা ” শব্দ দুটির অর্থবোধক মানে আলাদা হলেও একটির সাথে আরেকটির সর্ম্পক গভীর ভাবে জড়িত । একটি ছাড়া অন্যটি আমরা ভাবতে পারি না, পারাও সম্ভব নয় । বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের ঊষালগ্নের পাক-ভারত উপমহাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চিয়তার ঝড় উঠে তার প্রথম প্রতিফলন ফুটে ওঠে ৫২র ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ।আর বাঙালির সেই প্রথম স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার পাথেয় হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।

বাঙালি জাতির একুশ, একুশের চেতনা আর ৭১র মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে ।
সন ১৯৪৭ । ব্রিটিশ-ভারত তার স্বাধীনতা লগ্নে তিনটি ভাগে বিভক্ত হলো । ১৯৪০ সালে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিলো :-

“ That geographically contiguous unit are demarcated into regions which shall be so constituted, with such territorial re-adjustment as may be necessary; that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the north-western and eastern zones on India should be grouped to constituent units shall be autonomous and sovereign ”.

কার্যত হলো তার উল্টো । নবাব, ওমরাহ্ ও ভূস্বামীদের নিয়ে গঠিত মুসলিম লীগের নেতারা ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের নামে পূর্ব বাংলার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করলো ।
বিশ্বাসঘাতকতা করলো বাংলার মীরজাফর, খাজা নাজিমুদ্দিন, খাজা শাহাবুদ্দিন, নুরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ মুসলিম লীগ নেতা । পূর্ব বাংলা শৃঙ্খলিত হলো পশ্চিম পাকিস্তানি নয়া ধনপতি ও দালালদের হাতে । দুটি দেশ মাঝখানে স্থলপথে দুহাজার মাইল ও জলপথে তিন হাজার মাইল ব্যবধান । দুটি দেশ । তার ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা, আচার-আচারণ, ঐতিহ্য আলাদা । ধ্যন-ধারনা, অর্থনীতি আলাদা । দুটি ভিন্নমুখী দেশ আর জাতিকে ধর্মের দোহাই দিয়ে একটি রাষ্টে রাখা হলো । শুরু হলো পূর্ব বাংলার উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের ধন কুবেরের আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নির্যাতনের এক করুন ইতিহাস । এবং প্রথম হামলাটি এলো ভাষার ক্ষেত্রে । সংখ্যাগুরু বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে মুষ্টিমেয় সংখ্যা লঘুদের ভাষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্টভাষা করার চক্রান্ত হলো । কিন্তু বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, তরুন-ছাত্র-শ্রমিকরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ালো ।

এই আন্দোলনের একদিকে অশ্রুসজল, অন্যদিক আনন্দের । ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি  হঠাৎ করে আসেনি । এর পিছনে রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকদের কায়েমি ষড়যন্ত্রের ফলে বাঙালিদের দানা বাঁধা বহুদিনের ক্ষোভ । ১৯৪৭ সালে এ উপমহাদেশ থেকে ইংরেজরা বিদায় নিলে শুরু হয়েছিলো পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ । পূর্ব বাংলায় উপনিবেশিক শাসন কায়েম করতে তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথ বেছে নেয় । তারা চক্রান্ত করে বাঙালির প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে নস্যাৎ করতে । গোটা পাকিস্তানিবাসীর মধ্যে শতকরা ৫৬ জন অধিবাসীর মাতৃভাষা ছিল বাংলা । সুতুরাং রাষ্টভাষা বাংলার দাবি ছিলো তৎকালীন সাতকোটি বাঙালির প্রাণের দাবি, ন্যায দাবি । কিন্তু পশ্চিম শাসক গোষ্ঠী বাঙালির এ প্রাণের দাবিকে উপেক্ষা করে । উর্দুকে রাষ্টভাষা রুপে স্বীকৃতি দিয়ে তারা বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচারণ শুরু করে । ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা বলে ঘোষনা করেন । এর তিনদিন পরে ২৪-মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও তিনি এ কথার পুনরুল্লেখ করেন । তখন সেই মুহূর্তে  বাংলার জাগ্রত ছাত্র সমাজ এর প্রতিবাদ জানায় । বাংলার প্রাণে আঘাত, আগুন জ্বলে উঠে । সেই আগুন আর নেভেনি ।

০২.
১৯৫২ সালের ৩০-এ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেন । আর সেটা হয় আগুনের শিখায় কেরোসিন ঢালা । বাংলার অপমার জনসাধারণ নতুন করে জেগে উঠে । প্রাণের ভাষাকে, মায়ের ভাষাকে রক্ষায় এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে পূর্ব বাংলার সচেতন ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-জনতা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আন্দোলন, সংগ্রাম অব্যাহত রাখে । অবশেষে এলো একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশ শো বাহান্ন সাল । বাঙালির জাতীয় উন্মেষের প্রথম দিন । স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ ।

সেদিন পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলার ছাত্রসমাজ এগিয়ে যায় এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় এলে নিষ্ঠুর শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায় । ঝড়ে পড়ে কতগুলো তাজাপ্রাণ । বাংলার তরুণের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার পিচ ঢালা কালো রাজপথ । প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়ে যায় । শুধু কবির আবেগী কলম চলতে থাকে ...
                                      
                                        

                                 আধো দুপুর, আধো বিকেল
                                 ফাল্গুনের শির্ শির্ বাতাস
                                 আর বাংলার দামাল ছেলেদের-
                                প্রতিবাদী স্লোগান মিলেমিশে একাকার
                               
                                সবুজ প্লাকডে রক্তিম অক্ষর জ্বলজ্বল
                                মাতৃভাষা বাংলা চাই……
                                পোষ্টার, ফেস্টুন, প্লাকড
                                মানুষের ঢল আর স্লোগান
                                বইছে সমান তালে-
                                নাড়ীর টানে, ভাষার টানে, মায়ে্র টানে !
                                
                                ফাল্গুনের হাওয়া হঠাৎ থমকে গেল !
                                ওকি! কিসের শব্দ?
                                চারদিকে কোলাহল, অন্ধকার বারুদের গন্ধ
                                বুলেট ছুড়ছে পাষাণেরা !!!
                                থেমে থেমে আসছে আর্তচিৎকার
                                আর তা ছাপিয়ে
                                আমার মায়ের ভাষা বাংলা চাই
                                পশ্চিম কোণে হেলে পড়েছে সূর্য; আর-
                                তারি আভায় লালে লাল কৃষ্ণচূড়া
                                লালে লাল বাংলার রাজপথ !!!

সেই রক্ত বৃথা যায়নি । বাংলার অকুতোভয় ছাত্ররা রক্তের বিনিময়ে  ছিনিয়ে আনলো বাংলাকে, বাংলার ভাষাকে ।

আর এ চেতনায় উজ্জীবিত  বাংলার প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচন; শাসকদল মুসলিম লীগের তথা আমলাতন্ত্রের বিপর্যয়; গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট নৌকার জয় । আমলাতন্ত্রের প্রত্যাঘাত । গণতন্ত্র শিবির রক্ষায় ছাত্রসমাজ । আর এ প্রভাব লালন করেই ষাটের দশকের আন্দোলিত ক্রান্তিকাল পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় । এখানেই একুশের কালখন্ড- প্রখর সূর্যালোকের নিচে সংঘঠিত বিস্ফোরক ঘটনাক্ষণের কালজয়ী গুরুত্ব ।

কিন্তু জাতীয় চেতনার উন্মেষের মুহূর্তে বাঙালি জাতি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলো কী নিদারুণ ভাবে তাদের শোষণ করা হচ্ছে । একুশের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি দেখলো- যদিও পাকিস্তানের শতকরা ছাপান্ন ভাগের বাস পূর্ব বাংলায় তবু বাংলার মানুষকে সবদিক দিয়ে কিভাবে বঞ্চিত করছে ওরা । কী নিদারুণ বৈষম্য । বাঙালি দেখলো । ভাষায় আঘাত দিতে না পারার ব্যর্থতায় শুরু হলো একের পর এক প্রসাদ রাজনীতির চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে ভরা অধ্যায় ।

০৩.
১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ এই ছয়টি বছর ধরে পাকিস্তানের ইতিহাস হচ্ছে গুটিকয়েক ক্ষমতালিপ্সু, কায়েমি, সার্থবাদী, আমলা মুৎসুদ্ধি, সামন্তপ্রভু, ধনপতি, মদ্যপ বদ্ধোম্মাদ  রাজনৈতিক স্বার্থশিকারির প্রসাদ ষড়যন্ত্রের ইতিহাস । আর এই ইতিহাসের গুপ্ত পথ বেয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন জেনারেল আইয়ুব খান । বাঙালির আশা- আকাঙ্ক্ষার বুকে  পদাঘাত করে সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করলেন তিনি । বাঙালির বাক-  স্বাধীনতা, ব্যক্তি- স্বাধীনতা, সভা-সমতি, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা সমস্ত হরণ করে  নিয়ে বাংলার মানুষকে অবাধ শোষণের পথ উন্মুক্ত করলেন জেনারেল আইয়ুব খান ও তার সামরিক জান্তা ।

১৯৬২ সালে ঢাকার রাজপথে আবারো শহীদের রক্ত ঝরলো । রক্তের ধারা আবার প্রাবাহিত হলো ঢাকার রাজপথে ১৯৬৪ সালে । কিন্তু এই দুর্বার আন্দোলনের পথ বয়ে এলো ১৯৬৯ সাল । বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা আর ১১ দফার দাবিতে বাংলার ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ ঐক্যবদ্ধ এক দুর্বার গণ-আন্দোলনের জন্ম দিলো । অসংখ্য শহীদের রক্তে রাঙা হলো পূর্ব বাংলার শহর-বন্দর-নগর ।
শহীদের অমরত্ব লাভ করলেন আসাদ, জোহা, জহুরুল হক সহ আরো অসংখ্য দেশপ্রেমিক । কিন্তু শত শত গুলি বর্ষণেও এ আন্দোলনকে স্তদ্ধ করা গেলো না । ৬ দফা ও ১১ দফার মুক্তির সনদ নিয়ে বীর বেশে, বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে মঞ্চে অবর্তীণ হলো বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবর রহমান । এবং নির্বাচনে অবর্তীণ হলো তাঁর দল আওয়ামী লীগ । শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে এক বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করলো পূর্ব বাংলার জনগণ । ইতিহাস সৃষ্টি করলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল । বাংলার মানুষ যখন বিজয় উল্লাসে মত্ত , তখন............

লারকানার জঙ্গলের পশু শিকারে মিলিত হলেন তিন খল নায়ক । প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, চিফ অব স্টাফ আব্দুল হামিদ খান আর সুদক্ষ অভিনেতা প্রিন্স অব ডেনমার্ক জুলফিকার আলী ভুট্রো ।

বাঙালি  জাতির এই ক্রান্তিকালে আরো শক্ত, বলিষ্ট হাতে এ টালমাটাল জাতির হাল ধরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান । বাঙালি জাতি স্বপ্ন দেখলো, স্বপ্ন দেখলো স্বাধীন বাংলাদেশের । তাদের আশায় দীপ্ত আর প্রতিবাদী মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সেই ঐতিহাসিক মার্চে । বঙ্গবন্ধু আর বাঙালি জাতি বুঝে গেছে শান্তিপ্রিয় ভাবে আর সম্ভব না হলে তাঁদের কি করতে হবে । বঙ্গবন্ধু সমন্বয় ঘটালেন গান্ধীবাদী আর নেতাজীর  ঐক্যের ।

বাংলার ছাত্র-কৃষক-মুজুর অপেক্ষায় কড়িগুণতে আর রাজি নয়; তারা চায় স্বাধীনতা । ৫২র ভাষা আন্দোলনের চেতনা আবার বাঙালির রক্তে টগবগ করে ফুটে উঠলো । এমনি সময় ৩-ই মার্চ বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের হুশিয়ারি বানী দিলেন- “বাঙ্গালিকে আর দমন করিয়া রাখা যাইবে না ।”
অবশেষে আসলো সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ । রেসকোর্স ময়দানে জনসমাবেশ । বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন । মানুষে ছেয়ে গেলো রেসকোর্স ময়দান । প্রিয় নেতা মঞ্চে এসে দাড়ালেন, বললেন তাঁর প্রতিটি শব্দই যেন হীরন্ময় দ্রুতিতে ভাস্বর। কবি নির্মেলেন্দু গুণের ভাষায়-

                                    “ শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মত-
                                                                        দৃপ্ত পায়ে   হেঁটে
                                     অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাড়ালেন ।
                                     তখন পুলকে দারুণ ঝলকে তরীতে ঊঠিলো জল
                                     হৃদয়ে লাগিলো দোলা-
                                     জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা
                                     কে রোধে তাঁহার বজ্র কন্ঠ বাণী ?
                                     গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
                                                                  অমর কবিতাখানি-
                                                
                                     এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ।”



৪.
সেই থেকে আজ পর্যন্ত স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের । এত গৌরবময়, এত বেদনার জীবন বাঙালির জীবনে আগে কখনো আসেনি । বছর দুটি ১৯৫২ আর ১৯৭১ । এই দুটি বছরের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব বাংলাদেশকে জানলো, চিনলো এবং বুঝতে পারলো সবুজ, শ্যমল প্রকৃতির, কাদামাটির মতো নরম বাঙালি প্রয়োজনে কতটা ভয়ংকর হতে পারে ।

কোনো সন্দেহ নেই বাঙালি বর্ষাকালে যেমন কোমল, গ্রীষ্মে তেমনই রুক্ষ ও কঠিন । কে ভাবতে পারেছিলো  ভেতো বাঙালি নামে অভিহিত, কাপুরুষ পরিচয়ে পরিচিত বাঙালি জাতি পাকিস্তান নামের অবাস্তাব একটি রাষ্ট্রের জন্মের ছয় মাস যেতে না যেতেই আত্নপরিচয় প্রতিষ্ঠায়, মাতৃভাষার অধিকার অর্জনে সোচ্চার হয়ে উঠবে ? পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত বিরল যে, শুধু ভাষার জন্য সংগ্রাম করে  স্বাধীনতার বীজটি বপন করে ২৩ বছর যেতে না যেতেই একটি প্রদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রকাশ করে ।  এর জন্য সেই প্রদেশের অধিবাসীদের সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়েছে, যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে । এবং অবিশ্বাস্য সত্য হচ্ছে ভীরু, অলস, কর্মবিমুখ, কাপুরুষ, ভেতো, যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞ এই বাঙালিই মাত্র নয় মাসে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে । স্বাধীনতার জন্য প্রাণের আবেগ যখন দুর্দমনীয় হয়ে উঠে তখন পৃথিবীর যতই ভয়ংকর মরাণাস্ত্রই ব্যবহার করা হোক না কেন, সেই আবেগের কাছে তা তুচ্ছ হয়ে যায় । তাঁর প্রমাণ আমরা পেয়েছি আমেরিকা- ভিয়েতনামের যুদ্ধে, বাংলার ৫২র ভাষা আন্দোলনে । বিশ্ববাসী সেই প্রমাণ পুনরায় প্রত্যক্ষ করলো ১৯৭১ সালে এই বাংলায়, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে ।

অবশেষে বাঙালি পেলো সেই কাঙ্খিত স্বাধীনতার স্বাদ । আমরা জানি স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন । তাই বলে যার জন্য  এত বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়া, এত প্রাণ, এত রক্ত, এত আশা- আকাঙ্ক্ষা বির্সজন সেই স্বাধীনতার জন্য আমরা কি করছি । যে চেতনায় দাঁড়িয়ে বাংলার ভাষাসৈনিক আর মুক্তিসেনারা বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত করলো বাংলার রাজপথ-মাঠ-ঘাট । সেই চেতনা আজ কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে বা হয়েছে ?

সেই ৫২ থেকে ৭১র স্বাধীনতা পর্যন্ত নিপীড়িত বাঙালি জাতি যে চেতনায় থেকে স্বাধীন করলো দেশ তাঁদের সেই চেতনা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বাদ কতটুকু সার্থক হয়েছে তা সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ । রাজনৈতিক অরাজকতা, গণতন্ত্রের নামে পুঁজিবাদী অসাধুতা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে । নিজের মনুষ্যত্ব কে বিসর্জন দিয়ে হাঁটছি চোখ বন্ধ করে । শেখ মুজিবকে যারা নৃশংসভাবে খুন করতে গেলো তারাও দেশপ্রেমিক কিংবা গণতন্ত্রের পূজারী কিংবা নিপীড়িত জনগণ; তারাও ক্ষমতালোভী । ইতিহাস থেকে এরা শিক্ষা নেয় না । একজনকে খুন করে কে কবে সেই রক্তাক্ত সিংহাসনে বসতে পেরেছে ? তারা নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুড়ে ।

৫২ আর ৭১ এর ঘাতকেরা যে অপরাধ বিপুল হারে করেছিলো আজ সেই কাজই কি ছোট মাত্রায় কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে ঘটে চলছে না ?  প্রায়ত হুমায়ূন আজাদের আক্ষেপ আজও কানে বাজে –“ এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম ?” আমরা চাই না এমন বাংলাদেশ । আমরা চাই না । আমরা চাই না আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে যাক আমাদের অতীতকে । মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনায় যে মুক্তিযুদ্ধ, লাখো শহীদের যে আশা, বঙ্গবন্ধুর যে আশা- আকাঙ্ক্ষা তা বাস্তবায়ন করে আমাদের গড়তে হবে একটি সত্য, সুন্দর বাংলাদেশ ।
যেখানে থাকবে না কোন শ্রেণীভেদ । হাসি কান্না, দুঃখ থাকবে মিলেমিশে । যেখানে দুমুঠো ভাত শান্তিতে  খাওয়া যাবে, মায়ের ভাষায় কবিতা লেখা যাবে, এমন বাংলাদেশ চাই ।

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে –
বাংলাদেশের  মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ থেকে যে চেতনা লাভ করেছে তা জাতির সকল আন্দোলনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে । সমগ্র জাতি একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে একুশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে । ঐক্যবদ্ধ জাতি দেশ প্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে – তাঁর পিছনে একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ আজ সর্বজন স্বীকৃত । অত্যাচার আর শোষণের কালো হাত গুড়িয়ে দেওয়ার শক্তি ও প্রেরণা এসেছে এই একুশের চেতনা থেকেই । একুশের রক্ত থেকেই পরবর্তীকালে দেশের মুক্তির রক্তিম পতকা উড়েছে । লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙা হয়ে বাংলাদেশের আকাশে যে লাল সূর্যের আর্বিভাব হল তাঁর চেতনায় আছে ৫২’র দান করা রফিক, জব্বার আর নাম না জানা অসংখ্য ভাষা সৈনিকের রক্তের রঙ । তাই আমরা দেখতে পাই একুশের চেতনা জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে ।



৫.
“ মা কাঁদিছে পিছে ,
         প্রেয়সী দাঁড়ায়ে দ্বারে নয়ন মুদিছে ।
         ঝড়ের গর্জন মাঝে
         বিচ্ছেদের হাহাকার বাজে !

ঘরে ঘরে শূন্য হল আরামের শয্যাতল,
         যাত্রা করো, যাত্রা করো যাত্রীদল;
         উঠেছে আদেশ-
         বন্দরের কাল হল শেষ !

পঁচিশে মার্চের কালরাত্রিতে যারা আত্মহুতি দিয়েছেন, পঁচিশে মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত যারা রক্তাক্ত বাংলার ইতিহাস রচনায় বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছেন, যে লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়েছেন হানাদারের কাপুরুষোচিত আক্রমণে; তাঁদের কথা স্মরণ রেখে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে নিঃসার্থভাবে । যেখানে একটা সত্য, সুন্দর ও ন্যায় বাংলাদেশ আমরা তুলে দিতে পারবো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে । আর ৫২’র চেতনায় ৭১’ এর মতো আবারো উদ্ভাসিত হতে পারবে প্রতিটি শিশু । সেখানে ভুলবে না তারা বাংলার সূর্যসন্তানদের রক্ত, ভুলবে না মহান মুক্তিযুদ্ধের  চেতনা, ভুলবে না বাঙালি জাতির আর্দশ ।

সব ধরণের কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, জাতি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, সাম্প্রদায়িকতার শিকল থেকে বেড়িয়ে এসে লাখো শহীদের, কোটি বাঙালির স্বপ্নের সবুজ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে সবাইকে কাজ করতে হবে একযোগে ।
মাথা তুলে এই পৃথিবীর বুকে আরেকবার দাড়াতে চাই, নিঃসংকোচে, র্নিভাবনায় এবং বীরদর্পে !
               
                            “এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
                         জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয় ।” 


                                                                        ০৯/১১/১২ পাবনা  

আমার প্রিয় কিছু...

  • রবি ঠাকুরঃ- চোখের বালি, শেষের কবিতা, যোগাযোগ, গোরা, মালঞ্চ, বউ ঠাকুরানীর হাট, রাজর্ষি, নৌকাডুবি, ঘরে-বাইরে, চতুরঙ্গ, দুই বোন, চার অধ্যায়, প্রজাপ্রতির নিবন্ধ, সোনার তরী, গল্প গুচ্ছ সমগ্র, এবং গীতবিতান সমগ্র । - রবীন্দ্রনাথে আমি মনের অব্যক্ত কথা গুলো খুঁজে পাই । রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রশান্তি এনে দেয়, তাঁর গান কবিতা আমার মননে , আমার চিন্তায় বিল্পব ঘটায় । আমার চিত্তের কাছে আবেদন জানায় ।
  • বই- পথের পাচালি, অশনি সংকেত, প্রথম আলো-১,২, সেই সময়, পার্থিব, উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, মেমসাহেব, ময়ূরাক্ষী, জোছনা ও জননীর গল্প, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, ন হন্যতে, লা নুই বেঙলি , দেবদাস, পরিণীতা, পল্লি সমাজ, বামুনের মেয়ে, চিত্রনাথ
  • চলচিত্র- অশনি সংকেত, অরণ্যের দিবারাত্রি, মেমসাহেব, টেলিভিশন, মনের মানুষ